বিস্তারিত আরো পড়ুন

একটি গীতিকবিতার সুর দুই রকম করা যাবে না কি না, কোনো বাধ্যবাধকতা আছে?

ব্লগ  |  মিডিয়া  |  ফাহিম ফয়সাল

২০২৩-১১-১৩ ০১:০৯

একটি গীতিকবিতার সুর দুই রকম করা যাবে না কি না, কোনো বাধ্যবাধকতা আছে?

একটি গীতিকবিতার সুর দুই রকম করা যাবে কি না, এতে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে? আর সেটিও যদি হয় বহু বছর পর?

তারেক আনন্দ একজন গীতিকবি ও সাংবাদিক। তিনি তার ফেসবুক পেইজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসটি হচ্ছে- "জানার জন্য প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম। একটি গীতিকবিতার সুর দুই রকম করা যাবে না, এমন কি কোনো বাধ্যবাধকতা আছে। আর সেটাও  যদি হয় বহু বছর পর? ভালো লাগা না লাগা অনেক পরের বিষয়।"

তারেক আনন্দের স্ট্যাটাসে গীতিকবি ও সুরকার হাবিব মোস্তফা মন্তব্য করেছেন-  
"গীতিকারের জীবদ্দশায় গীতিকারের অনুমতিক্রমে একাধিক সুর করা যাবে। সে ক্ষেত্রে সুরকার একই ব্যক্তি হতে হবে। তবে সুরকার প্রয়াত হলে দ্বিতীয়বার সেই গান নতুন করে সুর করার/সামান্য পরিবর্তন করার কোনো বিধান নেই।"

এই বিষয়ে স্পেসিফিকভাবে বলার জন্য আরেকজন গীতিকবি ও সুরকার হাবিব মোস্তফা আমাকে ফেসবুক কমেন্টে মেনশন করেছেন। 

উভয়ের প্রশ্ন ও মন্তব্যের আলোকে কপিরাইট আইন এবং গান ও কপিরাইট নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার আলোকে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নিম্নের বিষয়গুলো আলোকপাত করলাম।

যেহেতু আমাকে মেনশন করে জানতে চেয়েছেন সেহেতু গান ও কপিরাইট নিয়ে আমার গবেষণার আলোকে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় কিছু কথা বলছি। আর সকলকে অনুরোধ করছি Third Angle থেকে বিষয়গুলো দেখতে। তাহলে সমাধান পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

এখানে তারেক আনন্দ জানতে চেয়েছেন- "একটি গীতিকবিতার সুর দুই রকম করা যাবে না, এমন কি কোনো বাধ্যবাধকতা আছে।"

বিষয় হচ্ছে- প্রথমত 'গীতিকবিতা' তখনই হয়, যখন কোন 'কবিতায়' সুরারোপ করা হয়। মানে কবিতায় সুরের পর যা হয় তাকে কিন্তু গান বলে। মানে গান হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে 'সুর' থাকতে হবে। আর গানের লিরিক (বাণী) হচ্ছে 'গীতিকবিতা'। 

সুতরাং প্রশ্নের এই অংশটি যদি এমন হয় যে, একটি কবিতায় দুই রকমের সুর করে গান রচনা করা যাবে কি না? 
তবে উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ প্রাথমিকভাবে অপ্রকাশিত অবস্থায় তা করা যাবে। শুধু দুই রকমের সুর না অনেকরকমের সুর করা যাবে বা যায়।

কারণ হচ্ছে- সাধারণত সুরকাররা যখন কোন কবিতাকে গানে রুপান্তরিত করতে প্রাথমিকভাবে সুর করেন তখন অনেক সময় একাধিক সুর করেন। পরবর্তীতে যেটি ভালো হয় সেটি কিন্তু ফাইনাল বা চূড়ান্তভাবে সংগীতায়োজন করে রেকর্ড করে গানে পরিণত করেন। আর বাকি সুরগুলো ফেলে দেন। ফাইনাল সুরের উপরই কিন্তু গানটি নির্মিত হয়। আর অবশেষে সেটি শ্রোতারা শুনতে পান। গানটি যে সুরের উপর রেকর্ড করা হয় সেটি ভালো হোক বা না হোক, জনপ্রিয়তা পাক বা না পাক তা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কপিরাইট অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গানটির 'মোরাল রাইটস' বা মেইন কপিরাইট স্বত্বাধিকারী হচ্ছেন গীতিকার ও সুরকার (এক বা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে)। বিষয়টি অনেকটা বাবা-মা'র মতো। একটি সন্তান জন্মের জন্য যেমন বাবা-মা আবশ্যক তেমনি একটি গান নির্মাণের জন্য কবি ও সুরকার দু'জনকেই লাগবে (এক বা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে)। দু'জনেই গানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে কবি বা গীতিকবি (যিনি গানের জন্য গীত রচনা করেন বা বাণী লিখেন) এবং সুরকার এক বা একাধিক ব্যাক্তি হতে পারেন।

তারেক আনন্দ প্রশ্নের সাথে জুড়ে আরও জানতে চেয়েছেন- "আর সেটাও যদি হয় বহু বছর পর? ভালো লাগা না লাগা অনেক পরের বিষয়।" 

কপিরাইট আইনের কোথাও এমন কোন ধারা নেই যে কেউ কাউকে বাদ দিয়ে গানটি রচনা করতে পারবে। বরং কপিরাইট আইনে গানের প্রণেতা হিসেবে কাকে ধরা হবে সে বিষয়ে ২৪ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে--
"প্রণেতা" অর্থ- "সংগীত বিষয়ক কর্মের ক্ষেত্রে উহার সুরকার বা রচয়িতা।" 

কপিরাইট আইনের ৭৮ ধারায় "প্রণেতার বিশেষ স্বত্ব" সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে-
"কোন কর্মের প্রণেতা ঐ কর্মের কপিরাইট স্বত্ব নিয়োগ বা পরিত্যাগ করা সত্বেও কর্মটির রচনা স্বত্ব দাবী করিতে পারিবেন এবং উক্ত কর্মের কোন বিকৃতি, অঙ্গহানি বা অন্যান্য পরিবর্তন সম্পর্কে অথবা উক্ত কর্মটির বিষয়ে তাহার সম্মান ও সুখ্যাতি ক্ষুন্ন হইতে পারে এমন অন্যান্য কার্যের জন্য ক্ষতিপূরণ বা কার্যের উপর নিবারণ দাবী করিতে পারিবেন।" 

'কপিরাইটের স্বত্ব বা মালিকদের অধিকার' অধ্যায়ের ১৭ নং ধারায় উল্লেখ করা আছে- 
"কপিরাইটের প্রথম স্বত্বাধিকারী- এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কোন কর্মের প্রণেতা ঐ কর্মের কপিরাইটের প্রথম স্বত্বাধিকারী হইবেন।" 

কারণ, আগেই বলেছি একটি গান হওয়ার প্রধান শর্তই হচ্ছে সুর (টিউন) থাকতে হবে। স্বরলিপি বা সুরের উপর ভিত্তি করে একটি গানের আবেগ, অনূভুতি প্রকাশ পায়। গানের সংগীতায়োজন করা হয়। এবং এই জন্যই সারাবিশ্বে গানের ক্ষেত্রে সুরকারকে 'ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ' বলা হয়। কারণ, গানের বাণী মনে থাক বা না থাক মানুষ কিন্তু গুনগুন করে গানের সুরটি গাইতে থাকে। এটি হচ্ছে সুরের শক্তি।   

এখন প্রশ্ন হলো, আইনে না থাকলেই কি আমার দ্বারা সুর বা কবিতাটি বাদ দিয়ে নতুন সুর বা গীত লেখা উচিত হবে কি না?

গান যেহেতু একটি সৃজনশীলকর্ম। আর ইন্টেলেকচুয়াল ওয়ার্কের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই কর্মটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌথ মেধা (এক বা একাধিক ব্যক্তি) দ্বারা সৃজিত হয় সেহেতু এটি চিরসুন্দর, স্নিগ্ধ ও মননশীল এক সৃজনশীল কর্ম। তাই গীতিকার বা সুরকারের কখনোই উচিত হবেনা সুরটি বা গীতিকবিতাটি খুব অল্প সময়ে এসে বা অনেকবছর পর এসে বাদ দিয়ে নতুন কোন সুর বা গীতিকবিতা রচনা করা। এবং পূর্বেই বলেছি, কপিরাইট আইনের ৭৮ ধারার "প্রণেতার বিশেষ স্বত্ব" হিসেবে তা করাও যাবেনা।

তবে মূল 'কপিরাইট স্বত্বাধিকারী' চাইলে, গীতিকার হলে গীতিকবিতায় আরও নানন্দিক বাণী আর সুরকার হলে সুরের সাথে আরও নানন্দিক সুর জুড়ে দিয়ে বা সংযোজন করে মূল বাণী বা সুর ঠিক রেখে নতুন সংগীতায়োজন করতেই পারেন। যা আমরা অনেক পুরাতন গানের ক্ষেত্রে 'ফিউশন' হিসেবে দেখতে পাই। 

এবার আসি হাবিব মোস্তফা'র মন্তব্য প্রসঙ্গে।
তিনি বলেছেন, "গীতিকারের জীবদ্দশায় গীতিকারের অনুমতিক্রমে একাধিক সুর করা যাবে। সে ক্ষেত্রে সুরকার একই ব্যক্তি হতে হবে।"

এই চিন্তাটি সঠিক নয়। কপিরাইট আইনের ২৪ নং ধারা অনুযায়ী গানের প্রণেতা যেহেতু সুরকার সেহেতু গীতিকবির অনুমতির প্রয়োজন নেই।

আর একটি গানের ক্ষেত্রে একাধিক প্রকাশিত সুর থাকাটা নান্দনিক নয়। যদিও আমরা অনেক দেখেছি, জনপ্রিয় একটি গানের সুরের উপর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন রকমের গীতকবিতা লিখে তা নতুন গান হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।

আর 'সুরকার একই ব্যক্তি হতে হবে' এমন কোন বিধান বা আইনও নেই। কারণ অসংখ্য গান রয়েছে যেগুলোর বাণী একাধিক ব্যক্তি লিখেছেন, সুরও একাধিক ব্যক্তি করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- দেশে-বিদেশে ব্যান্ডের অধিকাংশ গানই কিন্তু একাধিকজনের লেখা ও সুর করা।

সর্বশেষ হাবিব মোস্তফা'র আরেকটি পয়েন্ট হচ্ছে- 'তবে সুরকার প্রয়াত হলে দ্বিতীয়বার সেই গান নতুন করে সুর করার/সামান্য পরিবর্তন করার কোনো বিধান নেই।'

কপিরাইট আইনের ৭৮ ধারায় "প্রণেতার বিশেষ স্বত্ব" এর আলোকে এটি খুবই স্বাভাবিক যে, যিনি প্রণেতা তার সৃজনশীল কর্ম আরেকজনতো কোনভাবেই পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার কোন অধিকার রাখেন না। সুতরাং এই পয়েন্টটি ঠিক আছে।

আমার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (https://www.fahimfaisalofficial.com) কপিরাইট সংক্রান্ত নানা আর্টিক্যাল প্রকাশ করি। সময় পেলে পড়বেন। কিছু জানার থাকলে ইমেইল করবেন, পরামর্শ দেবেন। আশাকরি সুপরামর্শ দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ।

সবাইকে ভালোবাসা।

ফাহিম ফয়সাল
সংগীতশিল্পী, সংগীতপরিচালক, মাল্টিমিডিয়া স্পেশালিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কপিরাইট-ট্রেডমার্ক গবেষক-বিশ্লেষক-পরামর্শক।  
fahimfaisalinfo@gmail.com 
www.fahimfaisalofficial.com